নবী-রাসূলগণ জীবিত না মৃত? কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ

প্রশ্ন:

নবী-রাসূলগণ জীবিত না মৃত?  রাসূল (সা.) যখন মিরাজে গমন করেছিলেন, তখন মসজিদে আকসায় সমস্ত নবী-রাসূল তাঁর পিছনে নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি প্রতিটি আকাশে গিয়ে কিছু পরিচিত নবী-রাসূলদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যাঁরা নিশ্চিতভাবেই তার পেছনে নামাজ পড়েছিলেন। তাহলে কীভাবে নবী-রাসূলগণ একবার মসজিদে আকসায় এবং পরে আকাশে ছিলেন? নাকি তাঁরা এখনও জীবিত, তবে আমাদের থেকে ভিন্নভাবে?

 

 

উত্তর:

আলহামদুলিল্লাহ।

নবী-রাসূলদের জীবনের অবস্থা:

নবী-রাসূলগণ (আ.) পৃথিবীর দৃষ্টিতে মৃত। আল্লাহ তা’আলা সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন:

إنَّكَ مَيِّتٌ وَّإِنَّهُمْ مَّيِّتُوْنَ

নিশ্চয়ই আপনি মরণশীল, আর তারাও মরণশীল। (সূরা যুমার: ৩০)  

 

তবে আল্লাহর নিকট নবী-রাসূলগণ জীবিত। কারণ, যদি শহীদগণ আল্লাহর নিকট জীবিত ও মর্যাদাবান হন, তবে নবী-রাসূলগণ অবশ্যই তাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। (দেখুন: ফাতহুল বারী, ৬/৪৪৪)

রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন:

اَلْأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِيْ قُبُوْرِهِمْ يُصَلُّوْنَ

“নবীগণ তাঁদের কবরে জীবিত এবং তাঁরা নামাজ আদায় করেন।” (মুসনাদে বাযযার)।

শায়খ আলবানী (রহ.) সহীহুল জামে, হাদিস নং ২৭৯০-এ এটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন)।

আর কবরে এ নামাজ তাঁদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ এক নিয়ামত, যেমন জান্নাতবাসীরা তাসবীহ পাঠ করে আনন্দ উপভোগ করেন।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা হল, মৃত্যুর পর সকল নবীদের কবরে পুনরায় জীবন দান করা হয়েছে। ইমাম বাইহাকী রাহ. তাঁর ‘আল ই‘তিকাদ’ গ্রন্থে বলেন-

ْوَالْأَنْبِيَاءُ -عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ- بَعْدَمَا قُبِضُوْا رُدَّتْ إِلَيْهَم أَرْوَاحُهُمْ، فَهُمْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ كَالشُّهَدَاءِ

“সকল নবীর রূহ কবজ করার পর তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তাঁরা শহীদদের ন্যায় তাঁদের রবের কাছে জীবিত”। -আল ইতিকাদ পৃ.৪১৫ দারুল ফযীলাহ রিয়াদ; আত-তালখীছুল হাবীর ২/২৫৪; আল বাদরুল মুনীর ৫/২৯২ (সূত্র: মাসিক আল কাউসার)।

 

নবী-রাসূলগণের অবস্থান:

নবী-রাসূলগণ তাঁদের কবরস্থানে রয়েছেন এবং আল্লাহ তাঁদের আত্মাকে বিশেষভাবে জীবিত রেখেছেন।

তবে ঈসা (আ.)-কে আল্লাহ আকাশে উত্তোলন করে নিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:

وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوْا فِيهِ لَفِيْ شَكٍّ مِّنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلِّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوْهُ يَقِينًا – بَلْ رِّفَعَهُ اللهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللهُ عَزِيْزاً حَكِيْماً

তারা তাকে হত্যা করেনি এবং শূলেও চড়াতে পারেনি; বরং তাদের বিভ্রম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে যারা এ সম্পর্কে মতভেদ করেছে, তারা এ বিষয়ে সংশয়ে নিপতিত (এবং) এ বিষয়ে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের প্রকৃত কোনও জ্ঞান ছিল না। সত্য কথা হচ্ছে তারা ঈসা (আলাইহিস সালাম) কে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহ মহা ক্ষমতার অধিকারী, অতি প্রজ্ঞাবান। (সূরা নিসা: ১৫৭-১৫৮)। 

 

মসজিদে আকসা ও মিরাজের ঘটনা

নবী-রাসূলগণ মসজিদে আকসায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে নামাজ আদায় করেছিলেন তাঁদের আত্মা (রুহ)-এর মাধ্যমে। তাঁদের দেহ তখন কবরেই ছিল। এমনিভাবে, মেরাজের রাতে নবী (সা.) আকাশে বিভিন্ন নবীদের দর্শনলাভ করেন। তিনি প্রথম আকাশে আদম (আ.)-কে, দ্বিতীয় আকাশে ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.)-কে, তৃতীয় আকাশে ইউসুফ (আ.)-কে, চতুর্থ আকাশে ইদরীস (আ.)-কে, পঞ্চম আকাশে হারূন (আ.)-কে, ষষ্ঠ আকাশে মূসা (আ.)-কে এবং সপ্তম আকাশে ইবরাহীম (আ.)-কে দেখেন। অথবা এটি বিপরীত ক্রমেও হতে পারে। তিনি তাঁদের আত্মাগুলিকে দেহের আকারে চিত্রিত অবস্থায় দেখেছিলেন।”

কেউ কেউ বলেছেন, হয়তো নবী (সা.) তাঁদের সেই দেহ দেখেছিলেন, যা কবরস্থ করা হয়েছে। কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়।

তবে ঈসা (আ.) তাঁর রূহ ও দেহসহ আকাশে উঠেছেন। একই কথা ইদ্রিস (আ.) সম্পর্কেও বলা হয়েছে।

আর ইব্রাহীম (আ.), মূসা (আ.) এবং অন্যান্য নবীদের দেহ পৃথিবীতে কবরস্থ আছে।

আর মাসীহ (আ.) (আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর এবং সমস্ত নবীর ওপর) অবশ্যই পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। তিনি পূর্ব দামেস্কের সাদা মিনারের পাশে নেমে আসবেন, দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ক্রুশ ভেঙে দেবেন এবং শূকর হত্যা করবেন। এটি সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর এ কারণেই তিনি দ্বিতীয় আকাশে ছিলেন, যদিও তিনি ইউসুফ (আ.), ইদরীস (আ.) এবং হারূন (আ.)-এর চেয়ে উত্তম। কারণ তিনি কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, যা অন্য নবীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

আর আদম (আ.) প্রথম আকাশে ছিলেন, কারণ তাঁর বংশধরের সৌভাগ্যশীলদের আত্মা তাঁর কাছে উপস্থিত করা হয়। আর হতভাগাদের আত্মা তাঁর কাছে পেশ করা হয় না; কারণ তাদের জন্য তো আকাশের দরজা খোলা হয় না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না উট সূচের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে। তাই সৌভাগ্যশীলদের আত্মাগুলি তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার জন্য তাঁর নিকটবর্তী থাকা প্রয়োজন।

আর নবী-রাসূলগণের মসজিদে আকসায় নবী (সা.)-এর পেছনে নামাজ আদায় তারপর মিরাজে আকাশে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কারণ আত্মার বিষয়টি ফেরেশতাদের মতো। এক মুহূর্তে উপরে উঠে এবং আবার নিচে নেমে আসতে পারে। এটি দেহের মতো সীমাবদ্ধ নয়।

(মাজমূউল-ফাতাওয়া, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ৪/৩২৮-৩২৯, সামান্য পরিবর্তিত)।

 

এখান থেকে অনুবাদ করা হয়েছে

حياة الأنبياء – الإسلام سؤال وجواب

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।