ইসলামের আলোকে উত্তম মানুষ হওয়ার শিক্ষা
ইসলাম কেবল ধর্মীয় বিধানই নয়, বরং মানবজীবনকে সুন্দর, সফল এবং কল্যাণমুখী করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা উপস্থাপন করেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার হাদিসের মাধ্যমে মানুষের জীবনে উত্তম গুণাবলির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এই গুণাবলির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের আত্মোন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং সমাজে শান্তি, সুশৃঙ্খলা ও সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
এই প্রবন্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদিসের মাধ্যমে ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম মানুষ হওয়ার পথনির্দেশনা বিশ্লেষণ করব এবং প্রত্যেকটি গুণের বাস্তব গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
হাদিসে ১১ জন ব্যক্তিকে সর্বোত্তম মানব বলা হয়েছে।
১. যে নিজে কুরআন শিখে এবং (অন্যকে) শিখায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যে নিজে কুরআন শিখে এবং (অন্যকে) শিখায়।” (সহীহ বুখারী – ৫০২৭)
কুরআন হলো আল্লাহর বাণী, যা মানুষের জন্য জীবনের সব দিক নির্দেশ করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআন শিক্ষাকে সর্বোত্তম কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কারণ এটি মানুষের আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। একজন উত্তম ব্যক্তি কেবল কুরআন নিজে শিখে তা বুঝে কাজ করে না, বরং সে অন্যদেরও তা শিখিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করে।
২. যে চরিত্রগতভাবে সবচেয়ে উত্তম।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلَاقًا
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যে তোমাদের মাঝে চরিত্রগতভাবে সবচেয়ে উত্তম।” (সহীহ বুখারী – ৩৫৫৯)
ইসলামে একজন মানুষের চরিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য তার আচরণে, নৈতিকতা এবং ব্যক্তিত্বে প্রকাশ পায়। উত্তম চরিত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে দয়া, নম্রতা, সততা, সহানুভূতি এবং ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, একজন মুসলিমের উত্তম চরিত্রই তাকে সমাজে শ্রদ্ধা এবং সম্মান অর্জন করতে সহায়তা করে।
৩. যে ঋণ পরিশোধে সততার পরিচয় প্রদানকারী।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّ خِيَارَكُمْ أَحْسَنُكُمْ قَضَاءً
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যে তোমাদের মাঝে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম।” (সহীহ বুখারী – ২৩০৫)
ঋণ পরিশোধ ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে বিশ্বাসের বিষয়ে গণ্য করা হয়। একজন ব্যক্তি যদি ঋণ নিয়ে তা সময়মতো পরিশোধ না করে, তা তার সততার অভাব এবং আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের চিহ্ন হতে পারে। তাই, একজন উত্তম ব্যক্তি ঋণ গ্রহণের পর তা যথাসময়ে ও সততার সাথে পরিশোধ করে এবং নিজের প্রতি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে।
৪. যার থেকে কল্যাণের আশা করা যায় এবং তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُ النَّاسِ مَنْ يُرْجَى خَيْرُهُ وَيُؤْمَنُ شَرُّهُ
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যার থেকে কল্যাণের আশা করা যায় এবং তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকা যায়।” (জামে’ আত-তিরমিজী – ২২৬৩)
উত্তম ব্যক্তি হলেন সেই ব্যক্তি, যার থেকে সমাজ উপকার পায় এবং তার কারণে সমাজে কোনো ক্ষতি হয় না। এর মানে, একজন উত্তম ব্যক্তি সবসময় সমাজের কল্যাণে কাজ করে এবং কারো ক্ষতি করে না। সে এমনভাবে জীবনযাপন করে যে অন্যরা তার কাছ থেকে উপকার পায় এবং তার কারণে তাদের কোনো ক্ষতি হয় না।
৫. যে পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
ْخَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهٖ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যে নিজ পরিবারের (স্ত্রীর) কাছে সর্বোত্তম।” (জামে’ আত-তিরমিজী – ৩৮৯৫)
ইসলাম পরিবারের প্রতি সদয় আচরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। একজন উত্তম ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সৎ, শ্রদ্ধাশীল এবং সহানুভূতিশীল। পরিবারে যদি ভালো সম্পর্ক থাকে, তবে তা সমাজের অন্যান্য সম্পর্কের ওপরও ভালো প্রভাব ফেলে।
৬. যে অতিথিপরায়ণ এবং (অন্যের) সালামের উত্তর প্রদান করে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُكُمْ مَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ وَرَدَّ السَّلَامَ
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যে অন্যকে আহার করায় এবং অন্যের সালামের উত্তর দেয়।” (সহীহুল জামে’ – ৩৩১৮)
ইসলাম অতিথিপরায়ণতার এবং সালামের প্রচলনকে গুরুত্ব দেয়। একজন উত্তম ব্যক্তি অনাথ এবং অতিথিদের জন্য খাবার প্রদান করে এবং অন্যদের সালামের উত্তরে সদয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। এর মাধ্যমে সে সামাজিক সম্পর্কগুলোকে শক্তিশালী করে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
৭. যে নামাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করে এবং (অন্যের জন্য) বিনয় হয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خِيَارُكُمْ أَلْيَنُكُمْ مَنَاكِبَ فِي الصَّلَاةِ
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো, যে নামাজের কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে (অন্যের জন্য) কোমল হয়।” (সুনানে আবূ দাঊদ – ৬৭২)
নামাজের কাতারে শৃঙ্খলা এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার অন্তরের প্রশান্তি অর্জন করে এবং একইসাথে সমাজে একতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। নামাজে মানুষের মাধ্যমে আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব এবং সহানুভূতির বন্ধন দৃঢ় হয়।
৮. যার আয়ু দীর্ঘ হয়েছে এবং (এই দীর্ঘজীবনে) তার আমলও সুন্দর হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُ النَّاسِ مَنْ طَالَ عُمْرُهٗ وَحَسُنَ عَمَلُهُ
“সর্বোত্তম মানব হলো, যার আয়ু দীর্ঘ হয়েছে এবং তার আমলও সুন্দর হয়েছে।” (রিয়াজুস্ সলিহীন – ১১০)
দীর্ঘ জীবন তখনই সত্যিকার অর্থে লাভজনক হয়, যখন তা আল্লাহর রাস্তায় সদ্ব্যবহারে করা হয়। একজন উত্তম ব্যক্তি তার দীর্ঘ জীবনকে সৎকর্মে ব্যয় করে, যা তার পরকালীন সাফল্যের জন্যও এক প্রকার পুঁজি হয়ে থাকে।
৯. যে মানুষের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ
“সর্বোত্তম মানব হলো, যে মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকারকারী।” (সহীহুল জামে’ – ৩২৮৯)
উত্তম মানুষ সেই ব্যক্তি, যে জীবনে সর্বাধিক মানুষের কল্যাণ কামনা করে এবং অন্যদের সেবা করার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও উন্নতি আনে।
১০. যে সাথী এবং প্রতিবেশী হিসেবে উত্তম।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُ الأَصْحَابِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِصَاحِبِهٖ وَخَيْرُ الْجِيْرَانِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِجَارِهِ
“আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সাথী হলো, যে তার সাথীর কাছে সর্বোত্তম। এবং আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম প্রতিবেশী হলো, যে তার প্রতিবেশীর কাছে সর্বোত্তম।” (জামে’ আত-তিরমিজী – ১৯৪৪)
একজন উত্তম মানুষ তার সাথী ও প্রতিবেশীর জন্য সদয় এবং দয়ালু হবে। সে তাদের কল্যাণ কামনা করে এবং তাদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করে।
১১. যে পরিচ্ছন্ন হৃদয়বান এবং সত্যবাদী যবানের অধিকারী।
:قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ -صلى الله عليه وسلم ـ أَىُّ النَّاسِ أَفْضَلُ قَالَ كُلُّ مَخْمُومِ الْقَلْبِ صَدُوقِ اللِّسَانِ. قَالُوا صَدُوقُ اللِّسَانِ نَعْرِفُهُ فَمَا مَخْمُومُ الْقَلْبِ قَالَ: هُوَ التَّقِيُّ النَّقِيُّ لاَ إِثْمَ فِيهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ
“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলা হলো, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বললেনঃ প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি। তারা বলেন, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি, কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, সে হলো পূত-পবিত্র নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ যার কোন গুনাহ নাই, নাই কোন দুশমনি, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মঅহমিকা ও কপটতা। (ইবনে মাজাহ্ – ৪২১৬)
একজন উত্তম ব্যক্তির হৃদয় শুদ্ধ থাকে এবং তার মুখ থেকে কখনো মিথ্যা বের হয় না। সে পরহেজগার এবং ক্ষোভ, হিংসা বা অন্য কোনো গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে।
উপসংহার
ইসলাম মানুষের আত্মিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য একাধিক গুণাবলি অর্জনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদিসগুলো আমাদের শেখায় যে, উত্তম মানুষ হওয়ার জন্য কেবল ইবাদতেই নয়, বরং সামাজিক জীবনেও সত্য, ন্যায়, সহানুভূতি এবং সেবা প্রদানে মনোযোগী হতে হয়। আল্লাহ আমাদের এসব গুণ অর্জনের তৌফিক দিন। আমিন।
One thought on “ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম মানুষ হওয়ার গুণাবলি: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষায়”
আল্লাহ তায়া’লা আমাদের সবাইকে সর্বোত্তম মানব হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন